সড়ক-মহাসড়কে যখন দুর্ঘটনায় দিনে মৃত্যুর হার ৬৪ জনে গিয়ে ঠেকেছে, তখনও বাসচালকরা গতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কোন বাস কোনটাকে টপকাবে, কার আগে কে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবেন—এ নিয়ে রাতদুপুরেও চলে তাদের  প্রতিযোগিতার খেয়ালিপনা। শুধু গাড়িতে থাকা যাত্রীরাই নন, বাসগুলোর এই প্রতিযোগিতার কাছে অসহায় সড়কপথে চলাচলকারী ছোট যানবাহন ও পথচারীরাও। আবার এসব প্রতিযোগিতার দৃশ্য আপলোড করা হচ্ছে ইউটিউবে। গাড়ির সহযোগী বা সুপারভাইজারের করা ভিডিও বাস প্রতিষ্ঠানের আইডি বা নিজেদের লোকদের আইডি থেকে ইউটিউবে দেওয়া হচ্ছে।  কোনও কোনও ভিডিওতে গাড়ির গতি মিটারে ১২০ থেকে ১৪০ পর্যন্ত দেখা গেছে।

গত কয়েকদিনে ইউটিউবে বিভিন্ন আইডির ভিডিওতে দেখা গেছে, সারাদেশের বিভিন্ন রোডে চলা দূরপাল্লার বাসগুলোর পরস্পরের সঙ্গে গতির প্রতিযোগিতা করছেন। দিনে বা রাতে এই বাসগুলো গতির প্রতিযোগিতা চালায় কোনও কারণ ছাড়াই। হেলপার হয়তো ড্রাইভারকে বলছে, ‘ওস্তাদ, পারবেন, শ্যামলীকে খাইতে? চালক উত্তর দেন, দেখ কেমনে খাই।’ কথা দিয়ে কথা রেখে চালকেরা গাড়ির ভেতরে-বাইরে থাকা মানুষের প্রাণ নিয়ে মেতে ওঠেন মরণখেলায়। ইতোমধ্যে ইউটিউবে হিমাচল ০০৫৯ গাড়ির চালক জনির উপাধি দেওয়া হয়েছে ‘সাইলেন্ট কিলার জনি ভাই’। এই উপাধি পাওয়া আরও একজন চালক আছেন সাকুরা ও একে গাড়ির চালক শহীদ ভাই। ৮৫৬৭ নম্বর গাড়ির চালক আলমগীরকে স্মার্টবয় উপাধি দিয়ে আপলোড করা হয়েছে সাকুরা পরিবহনের গতি প্রতিযোগিতা। একুশে পরিবহনের চালক রাজনকে দেওয়া হয়েছে পাইলট শিরোনাম। আর পাবনা এক্সপেসের প্রবীণ চালক আমজাদ তো স্টিয়ারিং হাতে নিয়েই গানে মেতে ওঠেন আর গাড়ি চালান। হানিফ পরিবহন, সাকুরা পরিবহনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইডি থেকেই বাসের দ্রুতগতিতে ড্রাইভিং শেয়ার করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হানিফ পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার মোশারফ হোসাইন বলেন, ‘ইন্টারনেট তো আমরা বেশি বুঝি না। আমরা তো পুরনো দিনের মানুষ। তবে প্রতিযোগিতা করার বিষয়টি ঠিক নয়। এখন তো রাস্তার যে অবস্থা, জ্যাম থাকে, গতির প্রতিযোগিতা কিভাবে করবে? উত্তরবঙ্গে-দক্ষিণবঙ্গে গতির প্রতিযোগিতা দেওয়ার সুযোগ নাই।’

গতির প্রতিযোগিতায় হানিফ পরিবহনের একটি বাস

বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঈদুল আজহার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ জন মানুষের মৃত্যু হয় সড়কপথে আর এবারের ঈদুল ফিতরের আগে রংপুর শুধু একটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৭ জন শ্রমিক। এরপর ঈদের পর বৃহস্পতিবার এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২০ জন মারা যান। এদিকে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহনও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, এবারের ঈদের ছুটিতে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০ জন নিহত হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।

রাজধানীর মহাখালী, গাবতলী আন্তঃনগর বাসস্ট্যান্ডে এ বিষয়ে কথা হয় একাধিক চালক, সুপারভাইজার ও হেলপারদের সঙ্গে। তারা দ্রুত গতিতে বাস চালানোর পেছনে কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন। এর মধ্যে যাত্রীদের চাপসৃষ্টি, দ্রুত গন্তব্যে যাওয়ার তাগাদা, চালকদের কারও কারও ড্রাগসসেবন করে ড্রাইভিং করা, মহাসড়কে ছোট যানগুলোর নিয়ম না মানা, সুদূর গন্তব্যে চালকদের আপ-ডাউন ড্রাইভিংয়ে বাধ্য করা, সিনিয়র ও অভিজ্ঞদের ডাইভারদের পেশাত্যাগের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কারণ জানতে চাইলে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে ঢাকা-কুড়িগ্রাম রুটে চলাচলকারী পিংকী বাসের একজন চালক ও সুপারভাইজার বলেন, ‘বাস দ্রুত চালানোর কয়েকটি কারণ। একটি হচ্ছে কোনও সড়কে ফেরি থাকলে, ফেরি ধরার তাড়া। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া। তবে রাত বিরাতে বেশি গতি দেওয়ার পেছনে বড় কারণ, ‘বাবা।’’ ইয়াবাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘মদ-গাঁজা বিড়ি-সিগারেট তো স্বাভাবিক, কিন্তু এখন বাবা খাইয়া ওঠে।’

কিন্তু কেন ইয়াবা সেবন করতে হবে চালককে, এমন প্রশ্নের জবাবে পিংকী পরিবহনের এই চালক বলেন, ‘টানা ২৪ ঘণ্টা টিপ মারতে হয় ড্রাইভারদের। আপ-ডাউন করতে হয় বিশ্রাম ছাড়া। তাই ইয়াবা খাইয়া সজাগ থাকে। আর নেশাগ্রস্ত থাকে বলেই রাতে-দিন এক সমান। সামনে-পেছনে না দেখেই খালি ওভারটেক করতে চায়। এ জন্য দুর্ঘটনা ঘটে।’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী অভিযোগ করেন, ‘সড়কে প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানোর হাজারো অভিযোগ আমরা পেয়েছি। মালিকরা তার গাড়িটি গ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চালকদের ওপর চাপ দেন। আমরা এমন অভিযোগ প্রায় পেয়ে থাকি।’

মহাসড়কে একটি গাড়ির গতি ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার

তবে চালকরা বলছেন ভিন্ন কথা। দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোর বিষয়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে বসে কথা হয় এনা পরিবহনের চালক মো. বকুল, শাহ আলম, হানিফ খন্দকার ও একজন প্রবীণ চালকের সঙ্গে। মো. বকুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর ধরে বাস ড্রাইভিং করি। এনা পরিবহনের আগে জলসিঁড়ি, সৌখিন পরিবহনের বাস চালিয়েছি।’ সড়কে দুর্ঘটনার পেছনে তার পর্যবেক্ষণ, ‘গতির প্রতিযোগিতার জন্য না, সর্বপ্রথম যাত্রীদের গালাগালির কারণে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে হয়। একবার, দুই বার বা দশ বার সহ্য করা যায়, পুরো বাসের যাত্রীরা মিলে গাল্যাইবে, যদি গাড়ি আস্তে চালাই।’ বকুল আরও যোগ করেন, ‘এরপর প্রাইভেট কার। রাস্তার কোনও দিকে যেকোনও সময় কোনাকুনি করে গাড়ি রাখবে, লোকাল বাস সিগনাল ছাড়া, এন্ডিকাটার ছাড়া হঠাৎ করে বাস থামিয়ে দিলে আমাদের তখন কী করার থাকে?’

পাশ থেকে মন্তব্য করেন প্রবীণ একজন চালক বললেন, ‘এখন আর অভিজ্ঞ আর সিনিয়র চালক নেই। এই যে, আমি মাসে তিনটা চারটা টিপ মারি।’

জানতে চাইলে ঢাকা-সাতক্ষীরা রোডে চলাচলকারী ঈগল পরিবহনে নতুন যুক্ত হুন্দাই গাড়ির সুপারভাইজার মনির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রায় প্রত্যেকটা গাড়ির গতি ৮০’র ওপরে থাকে। ৩ মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ৬০ কিলোমিটার গতি ঠিক করে দিলেও এটা তো মানা হয় না। যাত্রীরাই চালকদের নানা ধরনের কটূক্তি করেন ধীরে চললে। এ কারণে দ্রুত গতিতে চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা থাকে চালকদের।’

তবে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আসলে হাইওয়েতে প্রতিযোগিতা হয় না। হাইওয়ের পথ দীর্ঘ। বিষয়টা এমন নয় যে, সে একবার ট্রিপ দিয়ে আবার একটি ট্রিপের জন্য প্রস্তুত হবে। এছাড়া হাইওয়েতে চলাচলকারী যানবাহনগুলো অনেক দামি। কোনও মালিক তার চালককে বলবেন না প্রতিযোগিতা করতে। কারণ, তিনি চাইবেন না তার গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। মালিকের যেমন তার গাড়িটির জন্য মায়া আছে, ঠিক চালকেরও তার জীবনের জন্য মায়া আছে।’

গত বছর প্রকাশিত বেসরকারি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেইঞ্জের গবেষণায় বলা হয়, ১০-১২টি কোম্পানির বাস সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেশি। এই কোম্পানিগুলো হলো, বিআরটিসি বাস, শ্যামলী, হানিফ, এনা, সাকুরা ও ঈগল পরিবহন, আজমেরী, এশিয়া, বিহঙ্গ, পদ্মা লাইন, পারিজাতক ও তুরাগ পরিবহন।

গত ৪ মার্চ ২০১৭ এ ঢাকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ওপর ইউরোপীয় অর্থনৈতিক কমিশন, ইউএনইসিই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে যান্ত্রিক যানের সংখ্যা মাত্র দু’টি। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট রোডে সবচেয়ে দুর্ঘটনার জন্য এনা পরিবহনকেই দায়ী করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শশই নামক স্থানে এনা পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে অন্য একটি যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসচাপায় ৮ জন নিহত ও ১ জন আহত হন। হতাহতরা সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী ছিলেন। নিহতরা সবাই বিয়ের যাত্রী ছিলেন। একই বছর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকায় এনা পরিবহনের বাসচাপায় মারা যান ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ছোট ছেলে ডা. মুশফিকুর রহমান শুভ। বেপরোয়া গতির বাসটির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। চলতি বছরে একই পরিবহনের একটি বাসের নিচে পড়ে রাজধানীর খিলক্ষেতে প্রাণ হারান তিনজন।

তবে এনা পরিবহনের চালক নবী হোসেন কাউকে সরাসরি দোষারোপ না করেই বলেন, ‘বাস চালাতে হলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয় নিজের ওপর। যত রাগই হোক, নিজের ওপর যার নিয়ন্ত্রণ নেই, তার অ্যাকসিডেন্ট হবেই।’ আরেক চালক মনির হোসেন বলেন, ‘আমাদের স্পিড এখন ৮০ ওপরে ওঠে না।’ তবে  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সড়কে আটজনের মৃত্যুর পেছনে মাইক্রোবাস চালকই দায়ী বলে জানান এনা পরিবহনের প্রবীণ চালক।

দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে ঈদের সময় যশোরের মনিরামপুরে একে ট্রাভেলসের বাস গাছের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। এতে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে  বলে জানান ঈগল বাসের সুপারভাইজার মো. মনির ।

জানতে চাইলে সড়কে দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ‘রাস্তার ত্রুটি, ড্রাইভারের ত্রুটি, হালকা-ধীরগতির গাড়ি, রোড ক্রসিং, ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি, হাইওয়ের পাশে দোকানপাট-বাজার, বাড়িঘর, ওভার লোডিং, নসিমন-করিমন, অতিরিক্ত প্রাইভেট গাড়ি চলাচলের কারণেই দুর্ঘটনা হয়।’

 

বাংলা ট্রিবিউন